তাজমহল

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - বাংলা - সাহিত্যপাঠ | | NCTB BOOK

প্রথম যখন আগ্রা গিয়েছিলাম তাজমহল দেখতেই গিয়েছিলাম। প্রথম দর্শনের সে বিস্ময়টা এখনও মনে আছে । ট্রেন তখনও আগ্রা স্টেশনে পৌছায়নি। একজন সহযাত্রী বলে উঠলেন- ওই যে তাজমহল দেখা যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালাম । ওই যে—
দূর থেকে দিনের আলোয় তাজমহল দেখে দমে গেলাম। চুনকাম-করা সাধারণ একটা মসজিদের মতো— ওই তাজমহল! তবু নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম। হাজার হোক তাজমহল। শাহজাহানের তাজমহল। ... অবসন্ন আপরাহে বন্দি শাহজাহান আগ্রা দুর্গের অলিন্দে বসে এই তাজমহলের দিকেই চেয়ে থাকতেন। মমতাজের বড় সাধের তাজমহল । ... . আলমগীর নির্মম ছিলেন না । পিতার ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন নি তিনি ... মহাসমারোহে মিছিল চলেছে ... সম্রাট শাহজাহান চলছেন প্রিয়া সন্নিধানে? আর বিচ্ছেদ সইল না ... শবাধার ধীরে ধীরে নামছে ভূগর্ভে ওই তাজমহলেই মমতাজের ঠিক পাশে শেষ-শয্যা প্রস্তুত হয়েছে তাঁর। আর একটা কবরও ছিল ... ... হয়ত এখনও আছে ... ওই তাজমহলেরই পাশে। দারা সেকোর ...
চুনকাম-করা সাধারণ মসজিদের মতো তাজমহল দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ।
পূর্ণিমার পরদিন। তখনও চাঁদ ওঠেনি। জ্যোৎস্নার পূর্বাভাষ দেখা দিয়েছে পূর্ব দিগন্তে। সেই দিন সন্ধ্যার পর দ্বিতীয়বার দর্শন করতে গেলাম তাজমহলকে। অনুভূতিটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই অস্ফুট মর্মর-ধ্বনি কানে এলো । ঝাউ-বীথি থেকে নয়- মনে হলো যেন সুদূর অতীত থেকে; মর্মর-ধ্বনি নয়, যেন চাপা কান্না । ঈষৎ আলোকিত অন্ধকারে পুঞ্জীভূত তমিস্রার মতো স্তূপীকৃত ওইটেই কি তাজমহল? ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলাম। মিনার, মিনারেট, গম্বুজ স্পষ্টতর হতে লাগল ক্রমশ। শুভ্র আভাসও ফুটে বেরুতে লাগলো অন্ধকার ভেদ করে। তারপর অকস্মাৎ আবির্ভূত হলো— সমস্তটা মূর্ত হয়ে উঠলো যেন সহসা বিস্মিত চেতনা-পটে। চাঁদ উঠলো। জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ ওড়নায় অঙ্গ ঢেকে রাজ-রাজেশ্বরী শাহজাহান-মহিষী মমতাজের স্বপ্নই অভ্যর্থনা করলে যেন আমাকে এসে স্বয়ং। মুগ্ধ দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম । তারপর অনেক দিন কেটেছে।
কোন কনট্রাক্টার তাজমহল থেকে কত টাকা উপার্জন করে, কোন হোটেল-ওয়ালা তাজমহলের দৌলতে রাজা বনে গেল, ফেরিওয়ালাগুলো বাজে পাথরের ছোট ছোট তাজমহল আর গড়গড়ার মতো সিগারেট পাইপ বিক্রি করে কত পয়সা পেত রোজ, নিরীহ আগন্তুকদের ঠকিয়ে টাঙাগুলো কি ভীষণ ভাড়া নেয়- এ সব খবরও পুরোনো হয়ে গেছে। অন্ধকারে, জ্যোৎস্নালোকে, সন্ধ্যায়, উষায়, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরতে বহুবার বহুরূপে দেখেছি তারপর তাজমহলকে। এতবার যে আর চোখে লাগে না। চোখে পড়েই না। ... পাশ দিয়ে গেলেও নয়। তাজমহলের পাশ দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয় আজকাল। আগ্রার কাছেই এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছি আমি ৷ তাজমহল সম্বন্ধে আর মোহ নেই। একদিন কিন্তু- গোড়া থেকেই শুনুন তাহলে ।
সেদিন ‘আউট ডোর’ সেরে বারান্দা থেকে নামছি, এক বৃদ্ধ মুসলমান গেট দিয়ে ঢুকলো। পিঠে প্রকাণ্ড একটা ঝুড়ি বাঁধা। ঝুড়ির ভারে মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে বেচারির। ভাবলাম কোনও মেওয়াওয়ালা বুঝি। ঝুড়িটা নামাতেই কিন্তু দেখতে পেলাম, ঝুড়ির ভেতর- মেওয়া নয়, বোরখাপরা মহিলা বসে আছে একটি। বৃদ্ধের চেহারা অনেকটা বাউলের মতো, আলখাল্লা পরা, ধপধপে সাদা দাড়ি। এগিয়ে এসে আমাকে সেলাম করে চোস্ত উর্দু ভাষায় বললে- নিজের বেগমকে পিঠে করে বয়ে এনেছে সে আমাকে দেখাবে বলে। নিতান্ত গরিব সে । আমাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ‘ফি’ দিয়ে দেখাবার সামর্থ্য তার নেই। আমি যদি মেহেরবানি করে-
কাছে যেতেই দুর্গন্ধ পেলাম একটা। হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে বোরখা খুলতেই (আপত্তি করেছিল সে ঢের) ব্যাপারটা বোঝা গেল। ক্যাংক্রাম অরিস! মুখের আধখানা পচে গেছে। ডানদিকের গালটা নেই। দাঁতগুলো বীভৎসভাবে বেরিয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। দূর থেকে পিঠে করে বয়ে এনে এ রোগীর চিকিৎসা চলে না। আমার ইনডোরেও জায়গা নেই তখন। অগত্যা হাসপাতালের বারান্দাতেই থাকতে বললাম। বারান্দাতেও কিন্তু রাখা গেল না শেষ পর্যন্ত। ভীষণ দুর্গন্ধ। অন্যান্য রোগী আপত্তি করতে লাগল। কম্পাউন্ডার, ড্রেসর, এমনকি মেথর পর্যন্ত কাছে যেতে রাজি হলো না। বৃদ্ধ কিন্তু নির্বিকার। দিবারাত্র সেবা করে চলেছে। সকলের আপত্তি দেখে সরাতে হলো বারান্দা থেকে। হাসপাতালের কাছে একটা বড় গাছ ছিল। তারই তলায় থাকতে বললাম। তাই থাকতে লাগল। হাসপাতাল থেকে রোজ ওষুধ নিয়ে যেত। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ইনজেকশান দিয়ে আসতাম। এভাবেই চলছিল ।
একদিন মুষলধারে বৃষ্টি নামল। আমি ‘কল’ থেকে ফিরছি, হঠাৎ চোখে পড়ল বুড়ো দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটা চাদরের দুটো খুঁট গাছের ডালে বেঁধেছে আর দুটো খুঁট নিজে দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে ভিজছে লোকটা! মোটর ঘোরালাম। সামান্য চাদরের আচ্ছাদনে মুষলধারা আটকায় না। বেগম সাহেব দেখলাম আপাদমস্তক ভিজে গেছে। কাঁপছে ঠক ঠক করে । আধখানা মুখে বীভৎস হাসি। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
বললাম- “হাসপাতালের বারান্দাতেই নিয়ে চল আপাতত।” বৃদ্ধ হঠাৎ প্রশ্ন করলে- “এর বাঁচবার কোনও আশা
আছে হুজুর?”
সত্যি কথা বলতে হলো- 'না।'
বুড়ো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি চলে এলাম ।
পরদিন দেখি গাছতলা খালি । কেউ নেই ।
আরও কয়েকদিন পরে- সেদিনও কল থেকে ফিরছি— একটা মাঠের ভেতর দিয়ে আসতে আসতে বুড়োকে দেখতে পেলাম। কী যেন করছে বসে বসে। ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুরের রোদ। কী করছে বুড়ো ওখানে? মাঠের মাঝখানে মুমূর্ষু বেগমকে নিয়ে ব্রিত হয়ে পড়েছে না কি? এগিয়ে গেলাম । কতগুলো ভাঙা ইট আর কাদা নিয়ে বুড়ো কী যেন গাঁথছে।
“কী হচ্ছে এখানে মিয়া সাহেব'
বৃদ্ধ সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সেলাম করলে আমাকে ৷
“বেগমের কবর গাঁথছি হুজুর।”
“কবর?”
“হ্যাঁ হুজুর।”
চুপ করে রইলাম । খানিকক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর জিজ্ঞাসা করলাম— “তুমি থাক কোথায়?”
“আগ্রার আশে-পাশে ভিক্ষে করে বেড়াই গরিব-গরবয়।” “ দেখিনি তো কখনও তোমাকে । কী নাম তোমার?”
“ফকির শাজাহান।”
নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।

Content added By

লেখক-পরিচিতি

বনফুল ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯এ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়ার মণিহারপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস হুগলির শিয়াখালায়। সাহিত্য জগতে ‘বনফুল' ছদ্মনামে খ্যাত ছোটগল্পকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবির আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। পেশায় ডাক্তার এই লেখক সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর স্বচ্ছন্দ দক্ষতার অসাধারণ পরিচয় রয়েছে ছোটগল্পে। সেখানে উঠে এসেছে বিচিত্র সব মানুষের জীবনছবি, যাঁদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে। তাঁর রচিত শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জঙ্গম', ‘স্থাবর’, ‘হাটে বাজারে’, ‘ভুবন সোম’, ‘গল্প সংগ্রহ', ‘কিছুক্ষণ', 'রাত্রি', 'ডানা' ইত্যাদি । মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী অবলম্বনে রচিত ‘শ্রীমধুসূদন' নাটক তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা। তাঁর বেশকিছু উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি পেয়েছেন । তিনি ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, ‘আনন্দ পুরস্কার’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক'সহ বহু পদক ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন । 
বনফুল ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।

Content added By

শব্দার্থ ও টীকা


অলিন্দ - চাতাল। বারান্দা।
দারা সেকো - দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। আওরঙ্গজেব তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে
বন্দি ও হত্যা করেন। তিনি উদার-হৃদয় ও বিনয়ী ছিলেন। পারস্য ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ করায় পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তিনি ।
তমিস্রা - অন্ধকার । অন্ধকার রাত।
মিনারেট - মিনারসদৃশ উঁচু স্তম্ভ। Minaret |
গম্বুজ - গোলাকার ছুঁচালো ছাদ
গড়গড়া - ছোট এক রকমের আলবোলা । মাটিতে রাখা হয় এমন লম্বা নলযুক্ত হুঁকো ।
টাঙা - দুই চাকাওয়ালা এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি।
মেওয়াওয়ালা -ফলবিক্রেতা।
আলখাল্লা - পা পর্যন্ত লম্বা এক রকম ঢিলা জামা।
চোস্ত - নিপুণ। ত্রুটিহীন।
ক্যাংক্রাম অরিস - গলিত মুখক্ষত। Cancrum oris
ড্রেসার - ক্ষতস্থান শুশ্রুষাকারী। Dresser |
গরিব-গরবয় -  গরিব-গুর্বা। দীন-দরিদ্র।
 

Content added By

পাঠ-পরিচিতি

বনফুলের “তাজমহল” গল্পটি তাঁর ‘অদৃশ্যলোকে’ গল্প-সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গল্পে অবিস্মরণীয় মহিমা পেয়েছে সমাজের নিচুতলার মানুষ ফকির শাজাহানের পত্নীপ্রেম । সে সম্রাট শাহজাহানের মতো তাজমহল নির্মাণ করতে না পারলেও ইট-বালি দিয়ে নিজের মতো করে মৃত বেগমের কবর গড়েছে। কাহিনি, ঘটনা ও চরিত্র রূপায়ণের দিক থেকে “তাজমহল” গল্পটি বিস্তৃত পরিসরের নয়। খুব সংহত শিল্প বিন্যাসই এ গল্পের বৈশিষ্ট্য। বনফুল তাঁর অন্যান্য গল্পের মতো এ গল্পেও অত্যন্ত সচেতনভাবে মিতবাক। এ গল্পের শেষ দুটি বাক্য না পড়লে গল্পের অন্তগূঢ় তাৎপর্য ধরা পড়ে না। অদ্ভুত চমকের ভেতর দিয়ে সেখানে প্রকাশিত হয় এক গভীর জীবনসত্য। এখানে মানবিক অনুভূতির বাস্তব চিত্রের প্রকাশ ঘটেছে, যেখানে লেখক যুগযুগ ধরে গড়ে ওঠা মানবিক সম্পর্ককে মহিমান্বিত করেছেন। এ গল্পে লেখক নিরপেক্ষ দর্শকের মতো ঘটনা সাজিয়েছেন নিরাসক্ত বর্ণনায়। গল্পটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত হওয়ায় কাহিনি, ঘটনা, চরিত্র কোনো কিছু সম্পর্কেই লেখক কোনো মন্তব্য ও বিশ্লেষণ যোগ করেননি। নিতান্ত প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য বর্ণনা ও সংলাপের বাইরে নেই কোনো বাহুল্য। সবচেয়ে বড় কথা, এ গল্পে যে জীবনসত্য ফুটে উঠেছে তা গল্পকার পাঠককে সরাসরি বলেননি। গল্প তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায়ই পাঠককে দিয়ে তা উপলব্ধি করিয়ে নেয়।

Content added By
Promotion